
স্টাফ রিপোর্টার
শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহাবুর রহমান শেখের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শরীয়তপুরের মুন্সিরহাটে বসবাসরত বেদে সম্প্রদায় পেয়েছেন তাদের নাগরিকত্ব। তারা যাযাবর জীবন ছেড়ে এখন স্থায়ী বসতি গড়তে শুরু করেছেন। জানা যায়, শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের মুন্সির হাটে ১শ ২০টি বেদে পরিবার বসবাস করে। এই ১শ ২০টি পরিবারের মধ্যে ছোট বড় পাঁচশতাধিক মানুষ রয়েছে। এই পাঁচশতাধিক মানুষের মধ্যে প্রায় আড়াই শতাধিক মানুষ তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ভোটার হয়েছেন। আর তাদের ছেলে-মেয়েরা পেয়েছেন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় লেখাপড়া করার সুযোগ।
ইতোমধ্যে অনেক বেদে তাদের আদি পেশা ছেড়ে দিয়ে চাকরি করছেন। অনেকে মুদি দোকান, চায়ের দোকান, মাছের ব্যবসা, কাপড়ের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। খুব দ্রুত তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটছে। তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে এলাকার মানুষের সাথে সু-সর্ম্পক গড়ে তুলছেন। জম্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে তারা অনেক সচেতন হয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, প্রায় ২৫-৩০ বছর আগে বেদে সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবার মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর থেকে শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের কীর্তিনাশা নদীর তীরে অবস্থিত মুন্সিরহাট গ্রামে বসতি গড়েন। সেখান থেকে তারা এলাকার সাপধরা, সাপেকাঁটা রোগীর বিষ নামানো, বানর নিয়ে সাপ খেলা দেখানো, সিঙ্গা লাগিয়ে বাত ব্যাথার বিষ নামানো, দাঁতের পোকা ফেলানো, পুকুর ডোবায় হারানো সোনা-রূপার গহনা তোলাসহ তাবিজ-কবজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমানে তারা শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের মুন্সিরহাট গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত কীর্তিনাশা নদীর পাড়ে জমি কিনে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছে।
বেদে সর্দার আব্দুস ছাত্তার বলেন, এখানে আমার অধিনে ১শ ২০টি পরিবার রয়েছে। তারা সবাই আমাকে মেনে চলে। আমাদের বড় শক্তি হচ্ছে ঐক্য। আমরা একতাবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করি। আমাদের এখানে পুরুষের তুলনায় মহিলারা বেশী পরিশ্রম করে। পুরুষরাও পরিশ্রম করে, তবে তুলনামূলক কম। অবসর সময় পুরুষেরা তাস খেলে এবং নারীরা লুডু খেলে সময় কাটায়। তিনি আরও বলেন, সাপ খেলা, ঝাড়-ফুক দিয়ে তাবিজ-কবজ বিক্রির ব্যবসা এখন মন্দা। মানুষ আর আগের মতো এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় না। তাই অনেকই বিকল্প ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তিনি বলেন, বেদে পরিবার গুলোতে প্রায় আড়াই শতাধিক ভোটার রয়েছে। গত নির্বাচনের সময় তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। এ বছর ভোটার হালনাগাদের সময় অনেকেই নতুন ভোটার হওয়ার জন্য অর্ন্তভূক্ত হয়েছে।

বেদে পরিবারের সন্তান অমিত হোসেন এবং জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা ডোমসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। নদী পাড় হয়ে আমাদের স্কুলে যেতে হয়। তাই প্রতিদিন স্কুলে যাই না। আমাদের এপাড়ে যদি একটি স্কুল থাকতো তাহলে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম।
বেদে পরিবারের সদস্য আরিফ হোসেন বলেন, আমাদের বাব-চাচারা যখন নৌকায় চরে যাযাবর জীবন যাপন করতেন, তখন আমরা লেখাপড়া করার সুযোগ পাইনি। ডোমসারের স্থানীয় বাসিন্দা হয়ে আমি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। আমার এক ভাই বর্তমানে আনসারে চাকরি করছে। শিক্ষার অভাবে আমাদের সমাজ অনেক পিছিয়ে আছে। তাই আমাদের সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে শিক্ষিত করবো।
বেদে পরিবারের আরেক সদস্য আল-আমিন বলেন, মানুষের সোনা-রূপার গহনা পুকুর বা ডোবায় পড়ে গেলে তা আমরা তুলে দেই। এ কাজে অনেক পরিশ্রম হয়। আমাদের সন্তানদের এ কাজ করতে দেব না। তাদের লেখাপড়া শিখাবো।
সাপুরে আফসার সরদার বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষের কাজ হিসেবে সাপ খেলা দেখাই। আমার কাছে কালি জাইত, খইয়া জাইত, গোখড়া, অজোগরসহ বিভিন্ন ধরনের সাপ আছে। সাপ গুলোকে দুধ, ব্যাঙ, মাছ, মুরগি ও কবুতরের বাচ্চা খাওয়াতে হয়। তাতে অনেক টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু সেই হিসেবে খেলা দেখিয়ে খুব বেশী আয় হয় না। স্ত্রী সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। ভাবছি এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় যোগ দেবো।
এ ব্যাপারে ডোমসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ চাঁন মিয়া মাদবর বলেন, বেদে সম্প্রদায়ের অনেকে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের সব ধরণের সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। মেম্বারের মাধ্যমে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধি ভাতা দেয়া হচ্ছে। তাদের ছেলে মেয়েরা যেন সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত হতে পাওে সেজন্য আমরা প্রতিনিয়ত খোঁজ খবর রাখছি। নদী পাড় হয়ে যেন শিক্ষার্থীরা খুব সহজে প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারে তার জন্য তাদের নৌকার ব্যবস্থা করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। বেদেরা তাদের মূল পেশা ছেড়ে লেখাপড়া করে বিকল্প পেশার সন্ধানে ছুটছে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করছে।
এ ব্যাপারে শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহাবুুর রহমান শেখ বলেন, বেদে সম্প্রদায়দের জন্য সরকার বিভিন্ন ধরণের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। তাদের স্থায়ী করার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রর ব্যবস্থা করেছেন। তাদের সন্তানদের শিক্ষা উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন ও সমাজ সেবার পক্ষ থেকে নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ ও পুরুষদের আইসিটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সাবলম্বি করতে বিভিন্ন ধরণের ঋণ দিচ্ছেন। তাদের শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সরকার কাজ করছে।
আপনার মন্তব্য