জোবেদা আক্তার
ঠিক মনে পরে না। কবে, কোন দিন, কোন ক্ষণে ভর্তি হয়েছিলাম ইডেন কলেজে। কেবল মনে পড়ে প্রচন্ড অনিচ্ছা নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেখতে এসেছিলাম আব্বুর সাথে। সেদিন জগন্নাথ কলেজে আমার পছন্দের বিষয় বোটানিতে ভর্তি হয়ে এসেছি। কিন্তু ভর্তির পরে হঠাৎ সেখানে দুই গ্রুপে মারামারি লেগে গেলো। আব্বু জগন্নাথ কলেজের ভর্তি ক্যান্সেল করে আমাকে ইডেন কলেজে নিয়ে আসলো।
ইডেন কলেজে পড়ে আমাদের এক প্রতিবেশি জানিয়েছিল আমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইনি। কিন্তু নোটিশ বোর্ডে খোঁজ নিয়ে দেখি আমার নাম চতুর্থ স্থানে রয়েছে। তখন আব্বুকে আর পায় কে ? আমাকে নগদে ভর্তি করে দিলেন। বাংলা বিষয়ে পড়ালেখা করবো এটা পার করে আসা শিক্ষা জীবনে কখনো এক মুহুর্তের জন্যও ভাবিনি।
সেই অনীহার জের ছিল প্রথম বর্ষ পরীক্ষার রেজাল্ট পর্যন্ত। প্রথম বর্ষের পরীক্ষার রেজাল্ট শুনে আব্বুর চেহারা মলিন হয়ে গেলো। মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছিল। নিজেকে খুব বেশি অপরাধী মনে হলো। ভাবলাম, যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়।
ইডেন কলেজের ফুটপাতে বসে আড্ডা, ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রাম, টি.এস.সিতে বসে আড্ডা সবই চলছিল দুরন্ত গতিতে। শুধু পড়ালেখা ছাড়া। এবার এ সব পড়ে রইলো বালিশের নীচে। নিজেদের উদ্যোগে বিভাগের ছয় সাতজন মিলে নিজেরাই পাঠচক্র শুরু করলাম। মেঘদুত, মেঘনাদবধ, মধ্যযুগের গীতিকবিতা, চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদাবলি, চন্ডিমঙ্গল, মনসামঙ্গল, কালকেতু উপাখ্যান, সঞ্চিতা, সঞ্চয়িতা-আরো কত কী। প্যারীদাস মিত্র থেকে জীবনানন্দ, ছোটগল্প থেকে প্রবন্ধসমগ্র কি না ছিল! ইডেন কলেজের বড় দিঘীটার পাড়ে ঘাসের বিছানায়, অশ্বত্থ গাছটার তলায় অথবা গেস্ট রুমের মহুয়ার গন্ধে মাতাল হতে হতে চলতো আমাদের পাঠচক্র।
একেক দিন একেক জন একেকটা বিষয় বা অংশবিশেষ পড়ে আসতো। বাকিরা তার কাছ থেকে বুঝে নিতাম। কি প্রচন্ডরকম নেশা ছিল। বুঝে নেবার, বুঝিয়ে দেবার। সেই সময়ে পৌরাণিক অভিধান থেকে শুরু করে বাংলা একাডেমির অভিধান, এমনকি গ্রীক পুরাণের বই পর্যন্ত কিনে চষে ফেলেছিলাম। “জানতেই হবে, বুঝতেই হবে”। এই শ্লোগানকে সামনে রেখে আমাদের প্রধান কাজ ছিল খুজে খুজে নতুন বই কেনা। কোথায় প্রদর্শনী হচ্ছে, কমিশনে বই পাওয়া যাচ্ছে এসবের জন্য চিলের মতো ছুটে বেড়াতাম। আমি, লিপি, দিনা, মিতা, সোমা, নাছিমা সবাই যেন ছিলো বাঁধাহীন, বন্ধনহীন।
ঢাকা শহরের এমন কোন জায়গা ছিলো না যেখানে দল বেঁধে যাওয়া হয়নি। কেবল বোটানিক্যাল গার্ডেন বাদে। এতো বছরেও আর আমার যাওয়া হয়ে উঠল না। ভ্যানে চেপে পা ঝুলিয়ে কলকল করতে করতে লালবাগ কেল্লায় যাওয়া, আহসান মঞ্জিল, বিজ্ঞান যাদুঘর, সেনাবাহিনীর যাদুঘর, জাতীয় যাদুঘর, বাংলা একাডেমি, দোয়েল চত্বর, কার্জন হল, কলা ভবন, বুয়েট কোথায় না ঘুরেছি ? সব ছিল হাতের মুঠোয়। দিনগুলো ব্যস্ত গতিময়, রাত গুলো ছিলো জোস্ন্যা রাতের কালো গোলাপের ন্যায় রঙ্গিন।
হোষ্টেলে থাকার সুবাদে প্রায় সময় লিপির বাসার খাবারের ব্যবস্থা ছিল। নকশি পিঠা, উৎসবের খাবার বেশ পেতাম। হলে থেকে খাবার না পাওয়া মেয়ে, যারা বাসা থেকে আসতো, ওরা বেশ দাক্ষিণ্য দেখাতো। আমরাও লুফে নিতাম। নাসিমা, সোমা হলে থাকতো আমার সাথে। জোহরা, সুফিয়া ওদের সাথে বিছানা শেয়ার করেছি। গণরুমে থাকার সময়টা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। একজন পড়ছে তো একজন গান শুনছে, একজন রুপচর্চা করছে, কোন বেডে পাঁচ ছয় জন মিলে কান ফাটানো আড্ডা, পাশেই কেউ ঘুমাচ্ছে নির্বিকার। এ জীবন আমাকে শিক্ষা দিয়েছে মেনে নিতে, মানিয়ে নিতে, শক্ত হয়ে দাড়াতে, নমনীয় হতে যা পরবর্তী জীবনে এই আমি, আমার আমি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
মনে পড়ে হলের সামনের দিঘীটার বুকে! সোডিয়াম লাইটের মিডিয়াম আলো পড়লে ঢেউগুলো চকচক করে উঠতো, আর আমাকে করতো হোমসিক। কেবল মনে হতো যেন, রাতের বাড়ি ফেরার লঞ্চের ঢেউ। বাড়ির জন্য মন কেমন করলেই আমি বারান্দায় গ্রীল ধরে দাড়িয়ে থাকতাম। তাকিয়ে থাকতাম দিগন্তহীন ভাবে। এখনও তাকিয়ে থাকি। সেই সব দিন গুলো এখন কেবলই স্মৃতি।
এখনও তাকিয়ে থাকি
সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৮ , ০০:১০
আপনার মন্তব্য