স্টাফ রিপোর্টার
নাম তার আশা মনি। বয়স দশ। যে বয়সে তার স্কুলে যাওয়ার কথা। সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা হৈ চৈ করে সময় কাটানোর কথা। সে বয়সে আজ তাকে ইটভাটায় কাজ করতে হচ্ছে। হায়রে নিয়তি ! অভাব তাকে আজ এ পর্যায়ে দাড় করিয়েছে। প্রতিদিন এক হাজার ইট টানার পর তার বিনিময়ে সে পায় ১২৫ টাকা। আশা মনির মতো প্রতিদিন প্রায় ৪শ শিশু শরীয়তপুরের বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করছে। অথচ আইন বলছে ১২ বছরের নিচের কোনো শিশুকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। কিন্তু শরীয়তপুরে শিশুদের দিয়ে ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করানো হচ্ছে। অন্তরঙ্গ ভাবে কথা হয় আশা মনির সাথে। তাদের বাড়ি লালমনিরহাট। সে জানায়, মা বাবার সাথে লালমনিরহাট থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার মূলনা ইউনিয়নের বোয়ালিয়া ব্রীজ সংলগ্ন লাইখোলা ভান্ডারি ব্রিকস ফিল্ডে এসেছে কাজ করতে। আশা মনি ও তার পরিবারের পাঁচ সদস্য এই ইটভাটায় কাজ করেছে। প্রতিদিন সে একটা করে একটি সারির ইট ওঠায়। প্রতিটি সারিতে এক হাজার ইট থাকে। এক হাজার ইট ওঠালে ইটভাটার মালিক ১২৫ টাকা করে দেন আশা মনিকে। “গরীব হয়ে জন্মেছি তাই ইটভাটায় কাজ করছি” বলে আশা মনি। আশা মনির ফুপু ফাহিমা বেগম বলেন, পেটের দায়ে শরীয়তপুরে এসে ইটভাটায় কাজ করছি। ৪০ হাজার টাকা দাদন নিয়েছি। ৬ মাস এই ইটভাটায় কাজ করব। আমাদের পরিবারের পাঁচজন এখানে কাজ করে। আশা মনিকে বাড়িতে একা রেখে আসা যায়নি। তাই নিয়ে এসেছি ইটভাটায় কাজ করতে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুরের ৬টি উপজেলায় ৫২টি ইটভাটা রয়েছে। সরেজমিনে এসব ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি ইটভাটায় ১২ বছরের কম বয়সী এমন শিশুরা কাজ করছে। এসব শিশুরা ইট তৈরি ও ইট টানার কাজ করে থাকে। প্রত্যেক শিশু ২০ কেজি ওজনের সমান ছয়খানা কাঁচা ইট মাথায় করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। জেলার ইটভাটাগুলো ঘুরে জানা যায়, ইটভাটায় কাজ করা শিশুরা অধিকাংশই এসেছে লালমনিরহাট, রংপুর, সাতক্ষীরা, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, বরিশাল ও চাঁদপুর থেকে। এই শিশু শ্রমিকদের অভিভাবকদের অনেককে ভাটার মালিকেরা দাদন দিয়েছেন। শিশুদের বাবা-মা কারখানার মালিকদের কাছ ছয় থেকে আট হাজার টাকা নিয়েছেন। এই টাকা নেয়ার কারণে ইটের কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে এসব শিশু। এসব শিশুরা ভাটাতেই ঘুমায়। ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলে যায় ইটখোলায়। টানার কাজ করে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এসব শিশু মূলত কাঁচা ইট মাটি থেকে তুলে ও মাথায় বহন করে। এক হাজার ইট টানলে দেয়া হয় ১২৫ টাকা। অধিকাংশ শিশু প্রতিদিন ৮শ থেকে ১ হাজার ইট টানতে পারে। লাইখোলা ভান্ডারি ব্রিকস ফিল্ডের ম্যানেজার আব্দুল খালেক বলেন, আমরা দাদন দিয়ে লোক আনি। যে লোক গুলো কাজ করে তারা ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম টাকা নিয়ে ভাটায় কাজ করতে আসে। একজনের ৩ থেকে ৪ জন সন্তান। তাদের বাবা-মা একা কাজ করে খাওয়াবে কী করে ? তাই তাদের বাচ্চারা কাজ করে। শরীয়তপুর জেলা ইট ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বাবুল বেপারী বলেন, বিভিন্ন জেলা থেকে ৫ থেকে ৬ জনের এক একটি পরিবার আমাদের জেলায় ইটভাটায় কাজ করতে আসে। তাদের সঙ্গে তাদের সন্তানরাও থাকে। ওই শিশুরা মাঝে মধ্যে ইটগুলো তোলে। তবে কোনো শিশুকে দিয়ে ইটভাটায় কাজ করানো হয় না। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শরীয়তপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোঃ মাসুদুর রহমান মাসুদ বলেন, ইটভাটার মালিকরা বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে তাদেরকে দিয়ে কাজ করান। দুঃখজনক হলেও সত্য এই শ্রমিকদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। শিশুদের দিয়ে ইটভাটায় কাজ করাচ্ছেন ভাটার মালিকরা। এটা অন্যায়। এ ব্যাপারে প্রশাসনের অবশ্যই দৃষ্টি দেয়া উচিৎ। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, আইন অনুযায়ী শিশুদের ইটভাটায় কাজ করানো যাবে না। ইটভাটার মালিকদের নিয়ে আমি অবশ্যই বসব। যদি শিশুদের দিয়ে ইটভাটায় কাজ করানো হয় তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
“গরীব হয়ে জন্মেছি তাই ইটভাটায় কাজ করছি” বলেন আশা মনি
মে ১১, ২০১৮ , ২১:৪৫
আপনার মন্তব্য