
কাজী নজরুল ইসলাম
না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমাদের সকলের প্রিয় ডোরা কাকিমা। শৈশব-কৈশরের হাজারো আবদারের ভরসাস্থল, আমার মত হাজারো সন্তানের এক মহীয়সী জননী আমাদের ডোরা কাকি আমাদের মাঝে আর নেই।
আমি বলছি সকলের শ্রদ্ধেয়া, আমাদের চিরচেনা, আংগারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক জননেতা আব্দুর রব মুন্সি স্যারের প্রিয়তমা সহধর্মীনি তাসলিমা আক্তার ডোরা কাকির কথা। তিনি আমাদের সকলকে কাঁদিয়ে, গভীর শোক সাগরে ভাসিয়ে, পাভেল-রুবেলের মতই তার হাজারো সন্ততানকে এতিম করে একেবারেই চলে গেলেন স্বর্গালোকের সুখতারা হয়ে না ফেরার দেশে।
গতকাল রাত পৌনে ১২টায় রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে কাকির বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।
১৯৭৩ সালে তখনকার তরুন উদীয়মান জননেতা আব্দুর রব মুন্সির সাথে তাসলিমা আক্তার ডোরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ৬০’র দশকে আব্দুর রব মুন্সি তখন বৃহত্তম ফরিদপুর অঞ্চলের বাম ঘরোনার এক তুমুল আলোচিত ছাত্রনেতা। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঝড় তোলা বক্তা। ৬৪ সালে রব স্যার মাদারীপুর নাজিম উদ্দিন কলেজের ভিপি নির্বাচিত হবার পর তিনি যখন গোটা ফরিদপুরে ছাত্র রাজনীতির লাল পতাকা হাতে নিয়ে চষে বেড়াতেন তখন পরিচয় হয় গোপালগঞ্জের আরেক ডাকসাইডেট নেতা লেবু মুন্সির সাথে। লেবু মুন্সির ছোট বোন তাসলিমা ডোরাও তখন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলেন। সেই ডোরা এক সময়ে বধু বেসে আসেন আব্দুর রব মুন্সির কুড়ে ঘরে।
সংসার জীবনে কাকি কখনই প্রাচুর্যের স্বাদ পাননি। আজীবন সংগ্রামী এক নারী ছিলেন তিনি। সংসারের ঘানি টানতে এক সময় তিনি সরকারি চাকুরীতে যোগদান করেন। রব মুন্সী-ডোরা দম্পতিতে ৬ জন সন্তান জন্ম নিলেও তাদের প্রথম পুত্র সন্তানটি মারা যায়। এরপর তানিয়া, সোনিয়া, সুফিয়া,পাভেল ও রুবেল একে একে কাকিমার কোলকে আলোকিত করে।
রব মুন্সি স্যার সারাটা জীবনই কাটিয়ে দিলেন রাজনীতিতে। ডোরা কাকি ছিলেন তার ছায়াশক্তি। ছিলেন রাজনীতিতে এক প্রবল অনুপ্রেরণা। এত কষ্ট, এত ঝঞ্ঝা ছিল স্যারের রাজনৈতিক জীবনে, তবুও কখনো দমে যাননি কাকি। অনেকগুলো সন্তান, সরকারি চাকুরী, হতাশাগ্রস্ত শত শত দলীয় কর্মী, স্কুলের অগনিত শিক্ষার্থীদের আবদার-অনুযোগ সব কিছু নিজের ধৈর্য্য আর বিচক্ষণতা দিয়ে মোকাবেলা করতেন কাকি। প্রচন্ড এক সহ্য ক্ষমতা ছিল তার। ১৯৮৫ এবং ১৯৯০ সালে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের পর সবচেয়ে দুঃসময় মোকাবেলা করতে হয়েছে রব স্যারের রাজনৈতিক জীবনে। এ সময় গুলোতে নানান মামলা মোকদ্দমা নিয়ে দৌড়াতে হতো স্যারকে। কিন্তু সব কিছু সামলে রাখতেন কাকি। রফিক মৌলভীর দোচালা টিনের ভাড়া ঘরে সুর্যোদয় থেকে গভীর রাত অবধি অসংখ্য সমস্যাগ্রস্ত মানুষের ভীর থাকতো স্যারের বাসায়। দাদপুরের সেকান্দার হাওলাদার, শাহেবালি সরদার, বিনোদপুরের গনি মিয়া মাদবরের মত মুরুব্বীরা অসংখ্য সমস্যা আর মামলা মাথায় নিয়ে আসতেন স্যারের কাছে। স্যার যখন থাকতেন না, তখন সব শুনে ন্যুনতম একটা শান্তনা দিয়ে হলেও সবাইকে সামলে নিতেন কাকি।
কত কষ্টইনা করে গেছেন গোটা জীবনে। কাকির হাতের এক কাপ লাল চা আর এক বাটি মুড়ি খাননি এ অঞ্চলের ছাত্র থেকে অভিভাবক, নেতা থেকে কর্মী এমন লোক বিরল। কোন দল বা মত ছিলনা কাকির কাছে। সবাইকে এক নজরেই দেখতেন। তাদের রাজনীতির চরম প্রতিপক্ষ, এমন পরিবারের সদস্য বা সন্তান যারা আংগারিয় হাই স্কুলে পড়া লেখা করেছে, তারা সবাই ছিল কাকির সন্তানের মত।
অল্প আয়ের সংসারে হোটেলের মত সব সময় চুলা জ্বলতেই থাকতো। মুখ দেখেই কাকি বলে দিতে পারতেন, কে অভুক্ত আর কে খেয়ে এসেছে। ক্ষুধা নিয়ে কেউ কোন দিন কাকির কাছ থেকে বিদায় নিতে পারেনি। আমরা যখন ছাত্র রাজনীতি করেছি, তখন আমাদের অভয়াশ্রম ছিল কাকির আচঁল। রাত দুইটার সময়ও আমাদের নিজ হাতে খাইয়েছেন কাকি। কখনো এতটুকু বিরক্তি দেখিনি তার ভেতর।
আমাদের সেই পরম পূজনীয়া মাকেই আমরা তার কিছু সন্তান জীবনের গোধুলী বেলায় অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার সময়টাও দিলেন না তিনি। ফাঁকি দিয়ে একেবারেই চলে গেলেন।
আল্লাহর কাছে সবাই দোয়া করুন, আমাদের কাকিমাকে আল্লাহ যেন ক্ষমা করে দেন। জান্নাতের উচ্চ মাকামে আল্লাহ যেন তাকে স্থান করে দেন। কাকির এতিম সন্তান পাভেল-রুবেলকে এই কষ্ট বহন করার শক্তি যেন আল্লাহ দান করেন।
আপনার মন্তব্য