স্টাফ রিপোর্টার
শরীয়তপুরের চাঞ্চল্যকর সজীব হত্যার মূল আসামী, পরিকল্পনাকারী এবং অর্থ যোগানদাতাকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে মামলার বাদী ও নিহত সজীবের পিতা আব্দুল কুদ্দুস সরদার। সম্প্রতি উক্ত মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামীর জামিন চাইতে সরকারী নিয়মকে উপেক্ষা করে আদালতে হাজির হয়েছে সজীবের পিতা কুদ্দুস সরদার।
এলাকাবাসী ধারণা করছে, সজীবের পিতা আব্দুল কুদ্দুস সরদার অনেক টাকা পেয়েছেন। যার কারণে তিনি পুত্র হত্যার কথা ভুলে প্রতিবেশী মতিউর রহমান মতি মুন্সিকে ফাঁসাতে মতি মুন্সির প্রতিপক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান কাওসারের সাথে হাত মিলিয়েছেন। অনেকের ধারণা কুদ্দুস সরদার নিজেই পুত্র হত্যাকান্ডে জরিত রয়েছেন। এ বিষয়ে এলাকায় নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২১ মার্চ শরীয়তপুর সদর উপজেলার নিলকান্দি গ্রামে প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে পূর্বপরিকল্পিতভাবে জবাই করে হত্যা করা হয় সজীব সরদার (১৯) নামের এক রিক্সাচালককে। এ বিষয়ে নিহতের পিতা কুদ্দুস সরদার ২৩ মার্চ মতি মুন্সিকে প্রধান আসামী করে ৯ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে পালং মডেল থানা পুলিশ অধিকতর তদন্ত ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হত্যাকান্ডের সাথে জরিত প্রকৃত আসামীকে সনাক্ত করে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন। গ্রেফতারকৃত আসামী রেজাউল করিম বেপারী ও জাহাঙ্গীর দেওয়ান হত্যার পরিকল্পনা ও দায় স্বীকার করে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬১ ধারা অনুযায়ী প্রথমে পুলিশের কাছে এবং পরে ১৬৪ ধারা অনুযায়ী আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। জবানবন্দিতে হত্যার পরিকল্পনাকারী ও অর্থ যোগানদাতার নামও প্রকাশ পায়।
মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, আদালতে আসামীরা জানায় চার জনের একটি কিলিং মিশন রিক্সাচালক সজীবকে জবাই করে ও কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাকারী ও অর্থ যোগানদাতা নিলকান্দি গ্রামের হাফেজ হাফিজুর রহমান মল্লিকের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান কাওছার গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দেয়। সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের জন্য অর্ন্তবর্তীকালিন জামিন গ্রহণ করে। গত ২৮ আগষ্ট পরিকল্পনাকারী মোস্তাফিজুর রহমান কাওছার শরীয়তপুর চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে আদালত আসামীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করেন।
মামলার সুষ্ঠু তদন্ত, অপরাপর সহযোগী আসামী গ্রেফতার ও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের লক্ষ্যে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর রূপু কর হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাকারী ও অর্থযোগানদাতা মোস্তাফিজুর রহমান কাওছারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে ২৯ আগষ্ট আদালতে আবেদন করেন। আগামী ৩ সেপ্টেম্বর রিমান্ড শুনানীর দিন ধার্য করেছে আদালত।
ইতোমধ্যে আসামীর জামিনের জন্য শরীয়তপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারী মিস-৯২৩/২০১৮ নম্বর কেস করেছে আসামী পক্ষের আইনজীবী। ৩০ আগষ্ট মিস কেসের শুনানীর দিন সজীব হত্যার পরিকল্পনা ও অর্থযোগানদাতাকে বাঁচাতে বিধি ভঙ্গ করে আসামী পক্ষের আইনজীবীর সাথে আদালতে উপস্থিত হয় মামলার বাদী ও নিহত সজীবের পিতা কুদ্দুস সরদার। তিনি আদালতে জানানোর চেষ্টা করে, কাওসার তার ছেলে হত্যার সাথে জরিত নয়।
স্থানীয়দের সাথে আলাপ কালে জানা যায়, কুদ্দুস সরদার ভূমিহীন, সরকারী জমি লিজ নিয়ে বাৎসরিক খাজনা দিয়ে বসত বাড়ি নির্মাণ করে কয়েক যুগ ধরে বসবাস করছে। কুদ্দুস সরদার পেশায় একজন রিক্সা চালক। দিন আনে দিন খায়। পূত্র হত্যার পরে তার আয় রোজগার কমে কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে উপরন্ত তার ভাগ্য আরও খুলে গেছে। বিগত ৩০-৪০ বছরের পুরাতন জরাজীর্ণ ঘরটি এখন নতুন টিনের ঘরে রূপান্তরিত হয়েছে।
এলাকাবাসীর ধারণা, মতিউর রহমান মতি মুন্সীকে ফাঁসাতে ছেলে সজীব হত্যার পরিকল্পনায় কুদ্দুস সরদারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এখন হত্যাকান্ডের মূল আসামীদের সাথে আতাত করে কুদ্দুস বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন। ছেলে হত্যার পর কুদ্দুস সরদারের ভাগ্য খুলে গেছে। হত্যার মূল রহস্য উৎঘাটনের জন্য মামলার বাদী কুদ্দুস সরদারকে রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন। তাহলে রহস্যের জট খুলবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর রূপু কর বলেন, মামলার ধৃত আসামী রেজাউল হক বেপারী ফৌজদারী কার্যবিধি ১৬৪ ধারানুয়ায়ী স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দিতে মোস্তাফিজুর রহমান কাওছারের নাম প্রকাশ পায়। তদন্তকালে জানা গেছে, মোস্তাফিজুর রহমান কাওছার গত ২১ মার্চ তারিখে পরিকল্পনা করে মতিউর রহমান মুন্সীকে সায়েস্তা করার জন্য অত্র মামলার বাদীর ছেলে সজীব সরদারকে হত্যার পরিকল্পনা করে। কারণ মতিউর রহমান মুন্সীর সাথে আসামী মোস্তাফিজুর রহমান কাওছারের দীর্ঘদিন যাবৎ বসত বাড়ির জমি নিয়ে বিরোধ ও মামলা চলছে। একই সাথে নিহতের পিতা কুদ্দুস সরদারের সাথেও জমি নিয়ে দ্বন্দ¦ ছিল। মতি মুন্সীকে সায়েস্তা করার জন্য আসামী মোস্তাফিজুর রহমান কাওছার সহযোগী আসামীদের নিয়ে টাকার চুক্তিতে বাদীর ছেলে সজীব সরদারকে হত্যা করেছে বলে তদন্তে প্রকাশ পায়। মামলা সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাপর সহযোগী আসামীদের পরিচয়, গ্রেফতার ও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করতে মোস্তাফিজুর রহমান কাওছারকে পুলিশ হেফাজতে আনিয়া ব্যাপক ও নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। তাই ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেছি।
শরীয়তপুর আইনজীবী সমিতির সিনিনিয়র আইনজীবী এ্যাডভোকেট মীর শাহাবুদ্দিন উজ্জল বলেন, সরকারী বিধি মোতাবেক আসামীর জামিনের বিষয়ে বাদী আদালতে উপস্থিত হয়ে অনাপত্তি দিতে পারে না। আসামী পক্ষের আইনজীবী বাদীকে আদালতে উপস্থাপন করেছে। এটা আইনের পরিপন্থি। বাদী যদি আদালতকে কোন বিষয়ে কিছু অবগত করতে চান, তাহলে বিজ্ঞ পিপি মহোদয়ের মাধ্যমে আসতে হবে। তা না করে তিনি আসামীকে রক্ষা করতে আসামী পক্ষের আইনজীবীর সাথে আদালতে এসেছেন।
এ বিষয়ে জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মির্জা হযরত আলী বলেন, এই মামলাটা আপোষ যোগ্য নয়। এমনকি জামিন যোগ্যও নয়। মামলার বাদী বা এজাহারকারীর আদালতে দাঁড়িয়ে কোন কিছু বলার থাকলে তা রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী হিসেবে আমার মাধ্যমে আসাটা আইনসম্মত।
আপনার মন্তব্য